মাছে ভাতে বাঙালি হিসাবে পরিচিত এদেশের মানুষের জীবন-জীবিকা, খাদ্যাভাস ও সংস্কৃতিতে মাছ গুরুত্বপূর্ণভূমিকা পালন করছে। এছাড়াও ক্ষুধা ও অপুষ্টি দূরীকরণে মাছ অন্যতম খাবার। মাছের উপকারিতা অপরিসীম ।
মাছে আমিষের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন, খনিজ পদার্থ ও উত্তম চর্বিবিদ্যমান। বর্তমানে আমাদের দেশে মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও দেশের জনসাধারণের অপুষ্টি দূরীকরণ ও সুষম খাদ্যাভাস গড়ে তোলার জন্য জনপ্রতি মাছ আহারের পরিমাণ বাড়াতে হবে। একজন প্রাপ্তবয়স্ক বাংলাদেশি এখন বছরে গড়ে ২২.৮৪ কেজি মাছ আহার করেন; যা আরও বৃদ্ধি করতে হবে।
এক নজরে মাছে বিদ্যমান পুষ্টি উপাদান:
মানব শরীরে বিভিন্ন ধরনের ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের চাহিদা পূরণে মাছের ভূমিকা
ভিটামিন-এ এর চাহিদা পূরণে মাছ:
মাছ হলো মানব শরীরে কার্যকর ভিটামিন-এ এর প্রধান উৎস। ছোট মাছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ভিটামিন-এ রয়েছে। বিশেষ করে ছোট মাছের চোখ ও ভিসেরা অঞ্চলে এ ভিটামিন থাকে। কারণ, ছোট মাছের যকৃতেই ভিটামিন-এ সঞ্চিত থাকে। আমাদের দেশে কিছু মাছের প্রজাতিতে গাজর ও পালং শাক হতে প্রাপ্ত ভিটামিন-এ এর তুলনায় দ্বিগুণ পরিমাণে ভিটামিন-এ থাকে।
বাংলাদেশের স্থানীয় দুইটি ছোট মাছের প্রজাতি মলা ও চান্দা মাছে প্রচুর পরিমাণে কার্যকর ভিটামিনএ রয়েছে। প্রতি ১০০ গ্রাম খাদ্য উপযোগী মলা ও চান্দা মাছে যথাক্রমে ২৫০০ মাইক্রোগ্রাম ও ১৫০০ মাইক্রোগ্রামেরও বেশি পরিমাণে ভিটামিন-এ থাকে। তবে যদি ছোট প্রজাতির মাছ পাতাজাতীয় শাক ও তেল দিয়ে রান্না করা হয় তাহলে ভিটামিন-এ এর পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পায়। ছোট মাছ ছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির বড় মাছে অল্প পরিমাণে ভিটামিন-এ বিদ্যমান।
ছোট মাছ (মলা) ও বড় মাছের (রুই) তরকারিতে পুষ্টিমানের পার্থক্য:
পুষ্টি উপাদান | মলা মাছের তরকারি (৫০ গ্রাম) | রুই মাছের তরকারি (৫০ গ্রাম ) | |
শক্তি | ১১৬ | ১১০ | |
আমিষ (গ্রাম) | ৫ | ৫.৯ | |
আয়রন | হিম আয়রন (মি.গ্রা.) | ০.৮৩ | ০.১১ |
নন-হিম আয়রন (মি.গ্রা.) | ০.৫৮ | ০.২১ | |
আয়রন RDI% | ১৪ | ৩ | |
ভিটামিন-এ | ৩,৪-ডিহাইড্রো রেটিনল আইসোমারস (মাইক্রোগ্রাম) |
১০৫৭ | |
রেটিনল আইসোমারস (মাইক্রোগ্রাম) | ১৯৬ | ||
বিটাক্যারোটিন (গ্রাম) | ২.৩ | ০.৫ |
ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণে মাছ:
মাছ ক্যালসিয়ামের ভাল উৎস। বিশেষ করে মাছের কাঁটাতে প্রচুর পরিমাণে ক্যালসিয়াম রয়েছে। তবে, বড় প্রজাতির মাছ কাঁটাসহ না খাওয়ায় বিদ্যমান ক্যালসিয়ামের বেশির ভাগই অপচয় হয়। তাই ছোট মাছ কাঁটাসহ খাওয়ার ফলে ছোট মাছ হতে আমরা বেশি পরিমাণে ক্যালসিয়াম পেয়ে থাকি। আমাদের দেশীয় পুঁটি ও চান্দা মাছে প্রচুর পরিমাণ ক্যালসিয়াম রয়েছে। প্রতি ১০০ গ্রাম খাদ্যোপযোগী পুঁটি ও চান্দা মাছে ৮০০ মিলিগ্রাম এর অধিক পরিমাণে ক্যালসিয়াম রয়েছে।
উল্লেখ্য, প্রতি ১০০ গ্রাম দুধে যে পরিমাণ ক্যালসিয়াম রয়েছে তার প্রায় আটগুণ বেশি ক্যালসিয়াম রয়েছে পুঁটি ও চান্দা মাছে। আবার মাছের কাঁটাতে যে ক্যালসিয়াম রয়েছে তার জীবতাত্তিকমান (Bioavailability) দুধের সমান। তাই ক্যালসিয়ামের চাহিদা পূরণে মাছ হতে পারে অতুলনীয়।
জিঙ্কের চাহিদা পূরণে মাছ:
বিভিন্ন ধরনের প্রাণিজাত খাদ্য যেমন: মাংস, দুগ্ধজাতীয় খাদ্য ও মাছে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে জিঙ্ক রয়েছে। তবে, ছোট মাছে বড় মাছ ও মাংসের তুলনায় বেশি পরিমাণে জিঙ্ক পাওয়া যায় (যদি কাঁটাসহ খাওয়া হয়)। বাংলাদেশে যেসব ছোট মাছ পাওয়া যায় তার মধ্যে মলা, চান্দা, কাঁচকি, চাপিলা, পুঁটি, টেংরা, দারকিনা ইত্যাদি। সকল প্রজাতির ছোট মাছে কম-বেশি জিঙ্ক পাওয়া গেলেও দাড়কিনা মাছে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে জিঙ্ক বিদ্যমান। প্রতি ১০০ গ্রাম খাদ্যোপযোগী দাড়কিনা মাছে ৪ মিলিগ্রাম জিঙ্ক রয়েছে। যা বিভিন্ন ধরনের মাংসজাত খাদ্যের চেয়ে কম নয়। তবে যেহেতু জিঙ্ক আমাদের শরীরে জমা থাকে না তাই প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ছোট মাছ হতে পারে জিঙ্কের চাহিদা পূরণে অন্যতম উৎস।
আয়রনের চাহিদা পূরণে মাছ:
দেশের মোট জনগোষ্ঠীর যে উল্লেখযোগ্য অংশ বিভিন্নধরনের অনুপুষ্টি উপাদানের অভাবে ভুগছে, আয়রন তার মধ্যে অন্যতম। আয়রনের অভাব দূরীকরণে ছোট মাছের ভূমিকা রয়েছে। বিভিন্ন প্রজাতির মাছে বিশেষ করে ছোট মাছে প্রচুর পরিমাণে হিম আয়রন রয়েছে। এই হিম আয়রনের বেশিরভাগ ছোট মাছের মাথা ও ভিসেরা অঞ্চলে বিদ্যমান। আয়রনসমৃদ্ধ বিভিন্ন শাক-সবজিতে যে আয়রন রয়েছে তা হলো নন-হিম আয়রন; যা আমাদের শরীর সহজে পরিশোষণ করতে পারে না। গরুর মাংসে বিদ্যমান হিম আয়রনের তুলনায় ছোট মাছে বিদ্যমান হিম আয়রন আমাদের শরীরে বেশি পরিশোষিত হয়।
আয়োডিনের চাহিদা পূরণে মাছ:
উদ্ভিজ্জ খাদ্যে আয়োডিনের পরিমাণ কম থাকায় আমাদের প্রতিদিনের চাহিদা পূরণে উদ্ভিজ্জ উৎস খুব কম ভূমিকা পালন করে। আমাদের শরীরে আয়োডিনের চাহিদা পূরণে পরিমিত পরিমাণে আয়োডিনসমৃদ্ধ লবণ ব্যবহারই মুখ্য। তবে, আমাদের দেশে প্রাপ্ত বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিশেষ করে, সামুদ্রিক মাছে যে আয়োডিন রয়েছে তা আমাদের শরীরের চাহিদা পূরণে ভূমিকা রাখে। তাই সামুদ্রিক মাছের উপকারিতা অনেক বেশি।
ফসফরাস, পটাশিয়াম ও সেলেনিয়ামের চাহিদা পূরণে মাছ
মাছ বিশেষ করে ছোট মাছে (কাঁটাসহ) প্রচুর পরিমাণে ফসফরাস ও পটাশিয়াম রয়েছে। এছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির মাছে সেলেনিয়াম বিদ্যমান; যা আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারি।
ভিটামিন B6 ও B12 :
উদ্ভিজ্জ খাদ্য উৎসে ভিটামিন B6 ও B12 তুলনামূলকভাবে কম পরিমাণে পাওয়া যায়। কিন্তু বিভিন্ন প্রজাতির মাছে প্রচুর পরিমাণে B6 ও B12 পাওয়া যায়।
কারনোসাইন (Carnosine) ও ক্রিয়েটাইন (Creatine) :
মাছে কারনোসাইন (Carnosine) ও ক্রিয়েটাইন (Creatine) নামক উপাদান রয়েছে। কারনোসাইন (Carnosine) এক ধরনের প্রোটেইক (Proteic) উপাদান; যা এলানাইন (Alanine) ও হিস্টিডিন (Hitidine) নামক এ্যামাইনোএসিড হতে উৎপন্ন হয়। অন্যদিকে ক্রিয়েটাইন (Creatine) উৎপন্ন হয় গ্লাইসিনে , আরজিনিন এবং মিথিওনাইন নামক এ্যামাইনোএসিড হতে। এই দুই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান শাক-সবজিতে পাওয়া যায় না।
এই ধরনের পেপটাইড উপাদান হৃৎপিন্ডে অথেরোস্কেরোটিক প্লাক তৈরির সম্ভাবনা কমিয়ে দেয়। এছাড়াও এরা পেশী ও মস্তিস্কে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে এবং মৃতপ্রায় কোষকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পারে। ক্রিয়েটাইন (Creatine) পেশী সংকোচন, পেশীর কোষে শক্তি সরবরাহ এবং এডোনোসিন ট্রাইফসফেট এর সাথে মিথস্ক্রিয়া করতে পারে। একজন মানুষের চাহিদার অর্ধেক তার শরীরেই সংশ্লেষণ হয় এবং বাকি চাহিদা পূরণের জন্য মাছ অথবা মাংস আহার করতে হবে।
পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড (ওমেগা-৩):
মাছে পর্যাপ্ত পরিমাণে উন্নত গুণসম্পন্ন চর্বিহিসেবে লম্বা শিকলযুক্ত পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড (ওমেগা-৩) রয়েছে; যা মাছ ব্যতীত অন্যান্য খাদ্যে পাওয়া যায় না। মাছে যে চর্বিবিদ্যমান তা অন্যান্য প্রাণিজাত খাদ্য উপাদান হতে প্রাপ্ত চর্বিহতে আলাদা। মাছে ওমেগা-৩ পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড পরিবারের মধ্যে মূলত EPA (Eicosa Pentaenic Acid)এবং DHA (Docosa Hexaenoic Acid) বিদ্যমান। ওমেগা-৩ তে মাছের উপকারিতা অপরিসীম।
মানব স্বাস্থ্যে EPA (EPA (Eicosa Pentaenic Acid) এবংDHA (Docosa Hexaenoic Acid) এর ভূমিকা:
- হৃদযন্ত্রের করোনারিকে (Coronary) সুরক্ষিত রাখে;
- বুদ্ধি বিকাশে সহায়তা করে;
- শিশু-কিশোরদের দ্রুত স্নায়ুবিক বৃদ্ধি সাধনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে;
- পূর্ণবয়স্কদের মস্তিস্কের কার্যক্ষমতা বজায় রাখে;
- বাতজনিত সমস্যা প্রতিরোধে ভূমিকা রাখে;
- গর্ভকালীন সময়ে ভ্রণের বৃদ্ধি উন্নত করে;
- দৃষ্টি শক্তি বজায় রাখতে সহায়তা করে;
- জিন ট্রান্সক্রিপশান ফ্যাক্টর (Gene Transcription Factor) নিয়ন্ত্রণ করে যা, চর্বিবিপাক ও ওজন কমাতেসহয়তা করে; এবং
- ক্যান্সার ও বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমায়; এবং
- মৃত্যু ঝুঁকি হ্রাস করে।
হৃদযন্ত্র সংক্রান্ত বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধে মাছের ভূমিকা:
- মাছ করোনারি জনিত হৃৎপিন্ডের রোগ প্রতিরোধ করে। কারণ, মাছে বিদ্যমান ইপিএ (EPA- (Eicosa Pentaenic Acid) যা এইকোজানয়িড (Eicosanoids) এর পূর্বের অবস্থা হিসেবে পোস্টাগ্লান্ডিনস ও লিউকোট্রায়েনস (পেশীর সংকোচন ও প্রসারণের সাথে সম্পর্কযুক্ত) এবং রক্তের থ্রম্বাক্সান উৎপাদনে সাহায্য করে।
- মাছে বিদ্যমান ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড বেশি পরিমাণে অথেরোস্কেরোসিস কোলেস্টেরল প্লাকের স্থায়িত্ব বাড়ায়, যা
- রক্তের জমাট বাঁধা প্রতিরোধ করে;
- হৃদযন্ত্রের অ্যারিথমিয়া প্রতিরোধ করে; এবং
- হৃদযন্ত্রের প্রভাবজনিত হঠাৎ মৃত্যু ঝুঁকি হ্রাস করে।
পুষ্টিবিজ্ঞানীদের পরামর্শ সপ্তাহে ৩৫০-৪০০ গ্রাম মাছ খেতে পারলে অনেক অসুখকে দূরে সরিয়ে রাখা যাবে। ছোট থেকেই মাছ খাওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারলে ভাল হয়। ইলিশ হোক বা পোনা, পাতে রাখুন এক টুকরো মাছ। মাছের উপকারিতা অনেক।