মাদকাসক্তি কী? চিকিৎসা ও পুনর্বাসন

| |

মাদকাসক্তি কী?

মাদকাসক্তি বলতে বোঝায় যে দ্রব্য সেবনের ফলে মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার নেতিবাচক পরিবর্তন ঘটে এবং ওই দ্রব্যের প্রতি দিন দিন নির্ভরশীলতা তৈরি হয়। এ জাতীয় দ্রব্যকে বলা হয় মাদকদ্রব্য আর এমন মাদকদ্রব্যের প্রতি কোন ব্যক্তির আসক্তিকে মাদকাসক্তি বলে।

মাদকদ্রব্য প্রকারভেদ :

দুটি উপায়ে মাদকদ্রব্য পাওয়া যায়।

 ১। প্রাকৃতিক

 ২। রাসায়নিক।

প্রাকৃতিক মাদকদ্রব্য : প্রাকৃতিক উপায়ে যে সকল মাদকদ্রব্য উৎপন্ন হয় তাকে প্রাকৃতিক মাদকদ্রব্য বলে।প্রাকৃতিক মাদকদ্রব্য প্রধানত গাছপালা থেকে পাওয়া যায়।যেমন:গাঁজা,তাড়ি,আফিম প্রভৃতি।

রাসায়নিক মাদকদ্রব্য : যে মাদকদ্রব্য পরিক্ষাগারে বিভিন্ন রাসায়নিক ক্রিয়া বিক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপন্ন হয় তাকে রাসায়নিক মাদকদ্রব্য বলে। প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপন্নজাত মাদকদ্রব্যের চেয়ে রাসায়নিক উপায়ে উৎপন্ন মাদকদ্রব্য বেশি নেশা সৃষ্টি করে। যেমন : মদ, এল.এস.ডি, হেরোইন, প্যাথেডিন, মারিজুয়ানা প্রভৃতি।

মাদকাসক্তি কাকে বলে?

মাদকদ্রব্য মাঝেমাঝে বা নিয়মিত গ্রহনের ফলে যেসব শারীরিক ও মানসিক নির্ভরতা সৃষ্টি হয় এবং ক্রমাগত সেই দ্রব্যের প্রতি তীব্র আকর্ষণ জন্মে সেই অবস্থাকেই মাদকাসক্তি বলে।

মাদকাসক্তি যে কত তীব্রভাবে মানুষের বুদ্ধিবৃত্তি ও ব্যক্তিত্বের  ক্ষতিসাধন করতে পারে তা কল্পনাতীত। মাদকাসক্তি সম্ভাবনাময় সৃজনশীল, কর্মচঞ্চল মেধাবী তারুণ্যকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। পুরো জাতিকে নিক্ষেপ করে এক ঘন কালো অন্ধকারে যা জাতীয় জীবনকে এক ভয়াবহ পরিণামের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

মাদকাসক্তির প্রক্রিয়া :

মানুষ বড় জটিল প্রাণী, বিচিত্র তার রূপ। অজ্ঞতা বশতঃ বিভিন্ন কাজে লিপ্ত হয়।

খারাপ চরিত্রের মানুষ যেমন সহজেই মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে,তেমনি ভাল মানুষও এর কবলে পড়তে পারে। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে,প্রথম টানেই দেহ ”নিউরোকেমিক্যাল’’ বা রাসায়নিক উপাদান বেরিয়ে মস্তিষ্ক কোষে একটা উত্তেজনা বা আরামের অনুভূতি তৈরি করে;যার ফলে এই অনুভূতির কাছে মানুষ বারবার নিজেকে সমর্পণ করে।

মানুষ প্রধানত ৩ ভাবে মাদকাসক্ত হতে পারে।

  • মানসিক কারণ।
  • সামাজিক কারণ।
  • জৈবিক কারণ।

মাদকাসক্তির সম্ভাব্য কারণসমূহ:

১। সাময়িক উত্তেজনা ও অপরিণত মন -ওষুধ গ্রহনের ফলাফল বুঝতে না পারা।

২। নতুনত্বের কামনা ও নতুন অভিজ্ঞতা লাভের আকাঙ্ক্ষা।

৩। মাদকের প্রতি কৌতূহল ও মাদকের কুফল সম্পর্কে অজ্ঞতা।

৪। জীবনের উদ্দেশ্যহীনতা, হতাশাবোধ,ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব কলহ,মনোমালিন্য ও অশান্তি ইত্যাদি।

৪। বিষণ্ণতা, দুশ্চিন্তা, দুর্ভাবনা, উৎকণ্ঠা ইত্যাদি উপশম করতে, কোন দুরহ মানসিক সমস্যাকে ভূলে যেতে কিংবা কঠিন বাস্তব থেকে সাময়িকভাবে নিজেকে দূরে রাখতে।

৫। ধর্মীয় উদাসীনতা, প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতি ও মূল্যবোধের বিরূদ্ধে বিদ্রোহের প্রবণতা।

৬। মাদকদ্রব্যের সহজপ্রাপ্যতা ও সহজলভ্যতা।

৭। চরম আর্থিক অনটন, পারিপাশ্বিক চাপ, সঙ্গদোষ, বন্ধু বান্ধবের অসৎ প্রলোভন ও প্ররোচনা।

৮। প্রেমে বিচ্ছেদ ও ব্যক্তিত্বের ত্রুটি।

৯। শৈশবের অপ্রীতিকর অভিজ্ঞতা ও সন্তানের সাথে পিতামাতার উচ্ছৃঙ্খল আচরণ ও ঝগড়া করা।

১০। পিতামাতার স্বেচ্ছাচারিতা, অবহেলা ও সন্তানকে তার প্রাপ্য আদর থেকে বঞ্চিত করা।

১১। বেকারত্ব, আর্থসামাজিক অঅস্থিরতা এবং বিশৃঙ্খলা।

১২। আল্ট্রামর্ডান হওয়া ও মাত্রাতিরিক্ত অনুকরণপ্রিয়তা।

১৩। যৌন স্বেচ্ছাচারিতা।

মাদকাসক্তির লক্ষণসমূহ:

  • হঠাৎ নতুন বন্ধুদের সাথে চলাফেরা শুরু করা ও আগের তুলনায় অনেক দেরিতে বাড়ি ফেরা।
  • মিথ্যা কথা বলার প্রবণতা ও বিভিন্ন অজুহাতে ঘনঘন টাকা চাওয়া।
  • রাত জেগে থাকা ও দিনে ঘুমের প্রবণতা বৃদ্ধি করা।
  • ঘুম থেকে জাগ্রত হওয়ার পর অস্বাভাবিক আচরণ করা ও অকারণে বিরক্তবোধ করা।
  • প্রচুর ঘুম হওয়া,অস্বস্তিবোধ হওয়া ও মন মানসিকতায় পরিবতর্ন দেখা দেওয়া।
  • খাওয়া দাওয়া কমিয়ে দেওয়া ও ওজন কমে যাওয়া এবং অতিরিক্ত মাত্রায় মিষ্টি খেতে আরম্ভ করা।
  • ঘনঘন পাতলা পায়খানা করা ও অযথা টয়লেটে দীর্ঘ সময় ব্যয় করা।
  • যৌন ক্রিয়ায় অনীহা এবং যৌন ক্ষমতা হ্রাস পাওয়া।
  • লেখাপড়া,খেলাধুলাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে অনীহা দেখা দেওয়া।
  • ঘরে তামাক বা সিগারেটের টুকরো পড়ে থাকা, প্লাস্টিক বা কাঁচের বোতল, ইনজেকশন, কাগজের পুরিয়াসহ নানাবিধ অস্বাভাবিক জিনিস পড়ে থাকা এবং কাপড়ে দুর্গন্ধ বৃদ্ধি পাওয়া ও পোড়া দাগ দেখতে পাওয়া।
  • এই সকল একাধিক বিষয় পরিলক্ষিত ব্যক্তি যে মাদকাসক্ত তা নিশ্চিতভাবে সন্দেহ করা যায়।

মাদকাসক্তির কুফল :

সাম্প্রতিককালে মাদকাসক্তি বহুলোক বিশেষত তরুণ সমাজকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করছে,সৃষ্টি করছে এক ভয়াবহ সামাজিক অবক্ষয়ের।মাদকাসক্তি সূক্ষ্মভাবে দেহের নানাবিধ ক্ষতি করে এবং এক পর্যায়ে দেহ তার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সম্পূর্ণ হারিয়ে ফেলে। মাদকাসক্তি বহু ধরনের রোগব্যাধি যেমন: হেপাটাইটিস, এইডস, ফুসফুসে ক্যান্সার, স্টোক, হৃদরোগ সহ যকৃত, মস্তিষ্ক ও মেরুদন্ডের বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করতে পারে।

মাদকাসক্তির প্রভাব:

মাদকদ্রব্যের হিংস্রতায় বিশ্বময় সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামোর উপর বহুমুখী প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। মাদকাসক্তরা পরিবার ও জাতির ভয়াবহ সর্বনাশ সাধন করছে। মাদকাসক্তি ও অপরাধ প্রবণতার মধ্যে রয়েছে নিবিড় সম্পর্ক। অপরাধ বিজ্ঞানীদের মতে,মাদকাসক্তি ও অপরাধ প্রবণতা পাশাপাশি চলে। এর ফলে দেশে চুরি, ডাকাতি, রাহাজানি, খুন, ছিনতাই, সন্ত্রাস ইত্যাদি প্রভাব বিস্তার করছে। মাদকের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক চোরাচালানি চক্র। চোরাচালান দেশের অর্থনীতিকে মারাত্মকভাবে পঙ্গু করে দিচ্ছে।

মাদক চোরাচালান ও মাদক ব্যবসা:

যেহেতু মাদক গ্রহীতার সংখ্যা ও মাদকের চাহিদা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি পাচ্ছে তাই মাদকদ্রব্যের উৎপাদনও বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাদকাসক্ত বৃদ্ধি যা আমাদের জন্য একটি উদ্বেগজনক সংবাদ। বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী দেশ হওয়ায় খুব সহজেই মাদকদ্রব্য পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন দেশ থেকে আমাদের দেশে প্রবেশ করে বিভিন্ন মাধ্যমে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। মায়ানমার থেকে ইয়াবা এবং ভারত থেকে ফেনসিডিল বেশি চোরাচালান হয়। এছাড়া আমাদের চারপাশে প্রতিনিয়ত বেশ কিছু মাদকদ্রব্য পাওয়া যায়।

মাদকদ্রব্য উৎপাদন ও পরিবহনে আন্তর্জাতিক রুট:

মাদকদ্রব্য উৎপাদন ও পরিবহনের জন্য তিনটি আন্তর্জাতিক রুট রয়েছে।

 ১। গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল -মায়ানমার, লাওস ও থাইল্যান্ড সীমান্ত।

 ২। গোল্ডেন ক্রিসেন্ট -বাংলাদেশ, নেপাল ও ভারত সীমান্ত।

 ৩। গোল্ডেন ওয়েজ -পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ইরান সীমান্ত। গোল্ডেন ওয়েজ সাধারণত হেরোইন উৎপাদনের উৎস। এছাড়া মেক্সিকো, যুগোশ্লেভিয়া ও হাঙ্গেরিতে কোকেন উৎপাদিত হয়। হাশিস উৎপাদনের জন্য জ্যামাইকা, মরক্কো, জর্ডান, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, নেপাল বেশ আলোচিত। এছাড়া বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশে গাজা উৎপাদিত হয়।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন :

যুগোপযোগী আইন প্রয়োগ ও বাস্তবায়নই পারে সমাজকে মাদকাসক্তি মুক্ত রাখতে। প্রয়োজনে আইন সংশোধন ও বাস্তবায়নে আলাদা ট্রাইব্যুনাল ও ভ্রাম্যমাণ আদালতসহ নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহনের মাধ্যমে মাদকমুক্ত সমাজ গঠনে আইন প্রয়োগ ভূমিকা রাখতে পারে।

মাদকদ্রব্য চিকিৎসা ও পুনর্বাসন :

চিকিৎসার মাধ্যমে একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এজন্য পর্যাপ্ত চিকিৎসাকেন্দ্র গড়ে তোলার সাথে সাথে সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া সুস্থ জীবনে ফিরে আসার পর যেন আবারও একইভাবে আক্রান্ত না হয় এজন্য পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করতে হবে।

সামাজিক সচেতনতাই এর একমাত্র হাতিয়ার :

সমাজের সর্বস্তরের মানুষ এই মরণ নেশা মাদকের প্রতি আক্রান্ত হচ্ছে। তাই আমাদের সমাজকে রক্ষায় আমাদের নিজেদেরই এগিয়ে আসতে হবে এবং সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে গণসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। আমরা যেখানেই থাকিনা কেন, আসুন আমরা সকলে মাদকে না বলি এবং মাদকদ্রব্য ও মাদকমুক্ত সমাজ গড়তে সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করি।

<

p style=”text-align: justify;”>প্রিয় পাঠক, আপনিও স্বাস্থ্য কথা অনলাইনের লেখক হয়ে উঠুন। লাইফস্টাইল ,ফ্যাশন, স্বাস্থ্য, ভ্রমণ, নারী, ক্যারিয়ার, পরামর্শ, খাবার, রূপচর্চা ও ঘরোয়া টিপস নিয়ে লিখুন এবং ছবিসহ মেইল করুন [email protected] এই ঠিকানায়। লেখা আপনার নামে প্রকাশ করা হবে। আমরাও আপনার উপর কৃতজ্ঞ থাকবো।

Previous

দাঁতের যত্নে নারকেল তেল কীভাবে ব্যবহার করবেন?

পেঁপের ছেচকি রেসিপি

Next

Leave a Comment