ফ্যাটি লিভার কোন উপসর্গ ব্যতীত লিভারের একটি নীরব রোগ, যাতে বিশ্বের ১২% প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ আক্রান্ত। বাংলাদেশে ফ্যাটি লিভার-এর প্রাদুর্ভাব ১২%-১৭%। ধারণা করা হচ্ছে, এটি ২০২২ সালের মধ্যে লিভার সিরোসিসের অন্যতম প্রধান কারণ হবে। ফ্যাটি লিভারের লক্ষণ সকলের ধারণা নেয়া দরকার।
ভবিষ্যতে রোগীদের স্বাস্থ্য সেবা উন্নত করার লক্ষ্যে চিকিৎসক এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকা জনগণের মাঝে একটি সেতুবন্ধন
তৈরি করতে হবে এবং তাই সাধারণ জনগণের মাঝে এ সচেতনতা তৈরি করা অত্যন্ত জরুরি।
ফ্যাটি লিভারের লক্ষণ:
- বেশির ভাগ রোগীই লক্ষণহীন থাকেন এবং সাধারণত ঘটনাক্রমে রোগটি নির্ণীত হয়। লিভার ফাংশন টেস্টে অস্বাভাবিকতা বা লিভার সাইজ বড় হওয়া বা অন্য রোগের জন্য পরীক্ষা করার সময়ে বিশেষত আলট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে রোগটি ধরা পড়ে।
- ফ্যাটি লিভারের সব থেকে বড় লক্ষণ হচ্ছে লিভার স্বাভাবিকের থেকে বেশি। বাহিরে থেকে আপনি কোমরের মাপ বা ভুঁড়ি অস্বাভাবিক ভাবে বাড়লে আপনি নিজেই বুঝতে পারবেন ।
- অনেক সময় অজান্তেই লিভারের কাজ করার ক্ষমতা কিছুটা ব্যাহত হয়। অনেক সময় বিলিরুবিন বৃদ্ধি পায় । বছরে একবার নিয়ম করে চেকআপ করার সময় লিভার এনজাইম দেখে নিতে পারেন ।
- লিভারে চর্বি জমলে স্বাভাবিক ভাবেই কাজ ব্যহত হয়। খাওয়ার প্রবণতা কমে যায়, খাবারে অরুচি বেড়ে যায় , দ্রুত ওজন কমে যায় , বমি বমি ভাব হয় , বমিও হওয়া, শরীর খুব দুর্বল লাগা ও কোনো কাজ করতে ইচ্ছে হয় না।
- ফ্যাটি লিভার হলে মাথাব্যথা, ডিপ্রেশন ও মন খারাপ, হটাৎ কাঁপুনি সহ নানা উপসর্গ দেখা দেয়।
- অপরিমিত মদ্যপান করলে লিভারের সমস্যার ঝুঁকি বাড়ে। এ ছাড়া টিবির ওষুধ, হরমোন ওষুধ, কিছু ব্যথার ওষুধসহ কয়েকটি অ্যান্টিবায়োটিকে লিভারের কর্মক্ষমতা কমতে পারে।
- নখ বা চোখ হলদেটে লাগলে অবিলম্বে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে লিভার টেস্ট করিয়ে নিতে হবে।
- আপনার হজমের সমস্যা ও অ্যাসিডিটি সমস্যা হতে পারে।
সচেতনতার প্রয়োজন কেন?
- লিভার মেটাবলিজমের কেন্দ্রবিন্দু। তাই লিভারের সুরক্ষা নিশ্চিত করা মানে সুস্থ্য জীবনের জন্য পুরো দেহকে সুরক্ষিত করা;
- উচ্চ ক্যালরিযুক্ত অস্বাস্থ্যকর খাবার এবং শরীরচর্চার অভাবে কি হয় এবং এগুলো কিভাবে লিভার ও জনস্বাস্থ্যের জন্য
হুমকি তা মানুষকে জানতে হবে; - ফ্যাটি লিভার স্থূলতা এবং ডায়াবেটিসের মতো রোগের সাথে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। কোন ধরণের উপসর্গ ব্যতীত
বাংলাদেশে ১২-১৭% মানুষ এতে আক্রান্ত; এবং - সাধারণ মানুষকে জানতে হবে ফ্যাটি লিভার যে কোন সাধারণ লিভার রোগ থেকেও বেশি কিছু, যা বিশ্ব স্বাস্থ্যের জন্য
হুমকি।
ফ্যাটি লিভার এর ঝুঁকিতে রয়েছেন ?
- ফ্যাটি লিভার বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অস্বাস্থ্যকর উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাদ্যাভ্যাস এবং শরীরচর্চার অভাবের কারণে হয়ে থাকে;
- যখন শরীরে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি চিনি এবং চর্বি জাতীয় খাবার গ্রহণ করা হয়, তখন সেটা লিভারে জমা হয়ে
- বিষক্রিয়া সৃষ্টি করে এবং লিভার কোষে ক্ষত তৈরি করে;
- স্থূলকায় ব্যক্তিরা ফ্যাটি লিভার এ আক্রান্ত হবার সবচেয়ে বড় ঝুঁকিতে রয়েছে;
- যাদের ডায়াবেটিস আছে তাদেরও ফ্যাটি লিভার এ আক্রান্ত হবার ঝুঁকি অত্যধিক;
- যারা দিনের বেশিরভাগ সময়ে বসে কাজ করেন তাদের আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি হয়;
- নারীদের ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি; এবং
- যে শিশুরা খেলাধুলা বা ব্যায়াম করে না, ফাস্ট ফুড, কোল্ড ড্রিংকস্, আইসক্রিম, চকলেট বেশি খায় তাদের ফ্যাটি
লিভার হবার ঝুঁকি বেশি।
ফ্যাটি লিভার হলে কি সমস্যা হয়-
- ফ্যাটি লিভারে আক্রান্ত রোগীদের মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হৃদরোগ সংক্রান্ত জটিলতা;
- হৃদরোগের উপরও ফ্যাটি লিভারের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে; এবং
- ফ্যাটি লিভার থেকে সিরোসিস এবং/অথবা ক্যান্সার হয় এবং পরিণতিতে লিভার নষ্ট হয়।
ফ্যাটি লিভারে শরীরচর্চার গুরুত্ব-
ফ্যাটি লিভার বা লিভার চর্বি রোগে প্রথম করণীয় হলো নিয়ন্ত্রিত কম চর্বিযুক্ত খাবার এবং শরীরচর্চা। গবেষণায় দেখা গেছে যে, শুধুমাত্র ৪ সপ্তাহ ব্যায়ামের মাধ্যমেই লিভারের চর্বি ১৮-২৯ % হ্রাস পায়। পরিমিত খাবার ও শরীরচর্চা সঠিকভাবে ২ বছর পালন করলে লিভারে চর্বি কমে যায়।
ফ্যাটি লিভারের ব্যায়াম-
- রোজ ঘণ্টাখানেক ঘাম ঝরিয়ে হাঁটতে চেষ্টা করুন।
- ট্রেড মিলে ঘন্টায় ৫-৬ কি.মি. গতিতে হাঁটা
- ধীরে ধীরে দৌঁড়ানো
- সাইকেল চালানো
- স্কিপিং (দড়িলাফ সম্ভব হলে)
- শারীরিক পরিশ্রম সম্পন্ন খেলাধুলা করা (ফুটবল, ব্যাডমিন্টন,
- টেবিল টেনিস, বাস্কেটবল) ইত্যাদি।
- দ্রুত হাঁটা
- ঘাম ঝরানো হাঁটা
- ট্রেড মিলে ঘন্টায় ৫-৬ কি.মি. গতিতে হাঁটা
- ধীরে ধীরে দৌঁড়ানো
শরীরচর্চার সময়কাল-
- প্রতিদিন শরীরচর্চা লিভারে চর্বি জমতে বাঁধা দেয়;
- তবে দৈনিক ৩০ মিনিট ও সপ্তাহে অন্ততপক্ষে ৫ দিন হাঁটলে লিভারের চর্বি হ্রাস হয়; এবং
- ব্যায়ামের ক্ষেত্রে দৈনিক ৩০ মিনিট ও সপ্তাহে অন্ততপক্ষে ৫ দিন।
শরীরচর্চা এমনভাবে করতে হবে যেন শরীরের ওজন ধীরে ধীরে ১০% কমে। এটি যাদের ওজন বেশি তাদের জন্য প্রযোজ্য। যাদের ওজন স্বাভাবিক তাদের ওজন কমাতে হবে না; কিন্তু নিয়মিত ব্যায়াম করতে হবে।
ফ্যাটি লিভার রোগে খাদ্য নির্দেশিকা-
- কোলেস্টেরল সমৃদ্ধ ও সম্পৃক্ত ফ্যাটযুক্ত খাবার বাদ দিতে হবে, যেমন- কলিজা, গরু ও খাসীর মাংস, চর্বি, হাঁসমুরগীর চামড়া, হাড়ের মজ্জা, ঘি, মাখন, ডালডা, পাঙ্গাস মাছ, গলদা চিংড়ী, নারকেল ইত্যাদির পরিবর্তে অসম্পৃক্ত ফ্যাট যেমন- উদ্ভিজ্জ তেল অর্থাৎ সয়াবিন তেল, জলপাই তেল, সূর্যমুখী তেল, সরিষার তেল ইত্যাদি খাবেন। অতিরিক্ত ট্রান্সফ্যাটযুক্ত খাবার যেমনঃ বেশি তেলে ভাজা খাবার, ঘি দিয়ে ভাজা খাবার, ফাস্টফুড পরিহার করবেন। ওমেগা-৩ ফ্যাটযুক্ত খাবার যেমনঃ সামুদ্রিক মাছ, তিসির তেল, আখরোট, বাদাম ইত্যাদি স্বাস্থ্যের জন্য উপকারি;
- অতিরিক্ত শর্করা লিভারে ফ্যাট হিসাবে জমা হয়; কাজেই ভাতের ব্যাপারে সাবধান হতে হবে। দুই বেলা আটার রুটি ও এক বেলা ভাত খাবেন। সাদা চাল ও আটার চেয়ে লাল চাল ও আটা উত্তম। অতিরিক্ত ফ্রুক্টোজ সমৃদ্ধ খাবার পরিহার করবেন যেমন- বিভিন্ন ধরনের কোমল পানীয়, কৃত্রিম জুস, চকলেট, সস ইত্যাদি। অতিরিক্ত চিনি, চিনি সমৃদ্ধ খাবার ও মিষ্টান্ন বর্জন করবেন;
- প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় আঁশবহুল খাবার যেমন- সব রকমের ডাল, শাক-সবজি ও ফল রাখবেন । তবে
ডায়াবেটিক রোগীদের পাকা আম, পেয়ারা, কাঁঠাল, আতা একটু হিসেব করে খেতে হবে। এছাড়া অধিক ফ্রুক্টোজযুক্ত
ফল যেমন-কিসমিস, আলুবোখারা, খেজুর, আঙ্গুরের রস, আম, কাঁঠাল, আপেল ইত্যাদি কম খাবেন। কালজাম,
লেবু, জাম্বুরা, আমলকি, আমড়া ইত্যাদি খেতে বাঁধা নেই। প্রতিদিন ইসবগুলের ভুষি খাওয়া উত্তম যা কোষ্টকাঠিন্য
প্রতিরোধের পাশাপাশি শরীরে কোলেস্টেরল কমাতে সহায়তা করে; - সর ছাড়া দুধ খাওয়া যাবে। এছাড়া নিয়মিত নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় টক দই খাওয়া শরীরের ওজন কমানোসহ স্বাস্থ্যের জন্য
বিভিন্ন উপকারী ভূমিকা পালন করে। হাঁস-মুরগীর ডিম খাওয়া যাবে; এবং - প্রতিদিন কমপক্ষে ২.৫-৩ লিটার পানি পান করবেন।
ফ্যাটি লিভারের হোমিও ঔষধ-
হোমিওপ্যাথি ঔষধ প্রাকৃতিক উপাদান দিয়ে তৈরি হয়, যা বহু গবেষণার পর রোগের লক্ষণ গুলি বিবেচনা করে রোগীকে দেওয়া হয়। হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা খুব জনপ্রিয়। এই প্রতিকারে প্রত্যেকের লক্ষণ আলাদা ভাবে বিবেচনা করার পরই কোন সার্বিক পদক্ষেপ নেওয়া হয়। হোমিওপ্যাথি ফ্যাটি লিভারের সমস্ত লক্ষণ গুলির প্রতিকার করতে দক্ষ এবং এই অবস্থার অবসান ঘটিয়ে পুনরায় ফিরে আসতে দেয় না।
চেলিডোনিয়াম-
পেটের ডান দিকে অস্বাভাবিক ব্যথা যা ফ্যাটি লিভারের লক্ষণ, তা নির্মূল করতে এটি সহায়ক। এই ক্ষেত্রে, লিভারের আকার বেড়ে যায় এবং রোগী কোষ্ঠকাঠিন্য, বমি বমি এবং বমির সমস্যায় ভোগেন। এবং রোগীর মধ্যে অত্যাধিক দুর্বলতা দেখা যায় এবং গরম খাদ্য ও পানীয় খাবার ইচ্ছা রাখে।
লাইকোপডিয়াম-
যদি গ্যাস বা অম্লতার সমস্যার জন্য ফ্যাটি লিভারের সমস্যা দেখা যায় তাহলে সেক্ষেত্রে এটি খুব উপকারী। এই ক্ষেত্রে রোগীর পেটের সমস্যা এবং জ্বালাভাব অনুভব করেন। এই ক্ষেত্রে রোগীর সন্ধ্যার দিকে শরীর খারাপ হয়ে যায় এবং মিষ্টি জাতীয় বা গরম পানীয় খেতে ইচ্ছা করে।
ফসফরাস-
এটি সেই ক্ষেত্রে ব্যবহার করা হয় যখন ঢেকুরের সাথে ফ্যাটি অ্যাসিড বের হয়। অনেক সময় রোগী এক্ষেত্রে পেটে ব্যথা অনুভব করে। এর সাথে বমি হয় এবং শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে।
ক্যালকেরিয়া কার্ব-
মোটা রোগীদের ক্ষেত্রে এই রোগের চিকিৎসা করা হয় ক্যালকেরিয়া কার্ব দিয়ে। এইসব মানুষের পেট ভার হয়ে থাকে, ল্যাকটোজের সমস্যা হয় এবং দীর্ঘ সময় ধরে কোষ্ঠকাঠিন্যর সমস্যা থাকে। এরা সবসময় ঠাণ্ডা জায়গায় থাকতে ভালোবাসে এবং প্রচণ্ড ঘেমে যায়।
নাক্সভোমিকা-
যে ফ্যাটি লিভারের ক্ষেত্রে কোন কিছুখাওয়ার পর পেট ব্যথা হয় তার প্রতিকার হিসাবে নাক্সভোমিকা ব্যবহার করা হয়।
অত্যাধিক অ্যালকোহল খাওয়ার জন্য যে ফ্যাটি লিভারের সমস্যা দেখা দেয় এবং সেক্ষেত্রে পেট ব্যথাও হয় সেই চিকিৎসার জন্য নাক্সভোমিকা খুব উপকারী। এই ধরণের রোগীর কোন কিছু তেতো খাওয়ার কয়েক ঘণ্টার পড়ে পেটে ব্যথা শুরু হয়। তাদের ক্রমাগত মল বের করার অনুভূতি পায় কিন্তু তারা তা করতে পারে না।
হোমওপ্যাথি ঔষধ যদি কম পরিমাণে গ্রহন করা হয় তাহলে তার কোন পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া হয় না, কিন্তু কখনওই নিজে থেকে কোন ঔষধ গ্রহন করা উচিৎ নয়। আপনি যদি ফ্যাটি লিভারের সমস্যায় ভোগেন, তাহলে দ্রুত হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন যে আপনার রোগ অনুযায়ী আপনার সঠিক চিকিৎসা করবে।
সৌজন্যে : বারটান