বাংলাদেশের প্রবীণদের সমস্যা | বার্ধক্য জনিত সমস্যা

| | ,

জীবনচক্রের প্রতিটি ধাপ অতিক্রম করেই একজন মানুষ বার্ধক্যে উপনীত হয়। বাংলাদেশের প্রবীণদের সমস্যা ও বার্ধক্য জনিত সমস্যা নিয়ে আজকের আলোচনা । বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) তথ্য অনুযায়ী মানবজীবনে ৬০ বছরের পর হতে বয়স্ককাল শুরু হয়। প্রবীণদের স্বাস্থ্য সমস্যা হওয়া খুবই স্বাভাবিক।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (BBS)-এর ২০১৮ সালের তথ্যানুযায়ী বর্তমানে ৬০ ঊর্ধ্ব বয়স্ক মানুষের সংখ্যা মোট জনসংখ্যার ৭.৯%। ধারনা করা হচ্ছে, দেশের মানুষের জীবনমান উন্নয়ন ও গড় আয়ু (৭২.৩ বছর) বৃদ্ধি পাওয়ার ফলে আগামীতে এ সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হবে।

৬০ বছরের পর বয়স্ককাল শুরু হলেও এর প্রায় ১০-১৫ বছর আগে থেকেই দেহে এর প্রক্রিয়া চলতে থাকে। ৪০-৪৫ বছর হতে দেহের বিভিন্ন গ্রন্থি ও কলার কার্যক্ষমতা হ্রাস পেতে আরম্ভ হয়; বিশেষ করে থাইরয়েড, অগ্ন্যাশয়, বৃক্ক, হৃদপিন্ড প্রভৃতি। এ কারণে বিপাকের হার ও শক্তি চাহিদাও কমে যায়।

প্রবীণদের স্বাস্থ্য সমস্যা:

  • দেহের বিভিন্ন গ্রন্থি, কলা বা টিস্যুর কার্যকারিতা হ্রাস পায়। এ কারণে বিপাকের হার ও শক্তি চাহিদা হ্রাস পায়;
  • পর্যাপ্ত খাদ্য গ্রহণ না করলে বা সূর্যের আলোর সংস্পর্শে না থাকলে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি- এর অভাব দেখা
    দেয়। ফলে হাড় নরম, সরু, পাতলা ও ভঙ্গুর হয়ে থাকে। এজন্য বৃদ্ধ বয়সে শরীরের কাঠামো দুর্বল ও শরীর ধনুকের
    মত বেঁকে যায় এবং অল্প আঘাতেই হাড় ভেঙ্গে যায়, তথা অস্টিওম্যালেসিয়া ও অস্টিওপোরোসিস রোগে আক্রান্ত
    হয়। এছাড়া এ বয়সে প্যারাথাইরয়েড হরমোন এর ক্ষরণ বৃদ্ধি পায়; ফলে হাড়ক্ষয় রোগও বাড়তে থাকে;
  • বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে জিহবার স্বাদ অনুভূতি বা টেস্ট বাড হ্রাস পাওয়ায় খাদ্য গ্রহণের প্রবণতাও হ্রাস পায়। এছাড়াও
    লালারসের ক্ষরণ কমে যাওয়ায় মুখ শুষ্ক হয়ে থাকে এবং দাঁত ক্ষয় ও পড়ে যাওয়ার ফলে খাবার চিবিয়ে খেতে ও
    গিলতে কষ্ট হয়;
  • পরিপাকতন্ত্রের কার্যক্ষমতা ও এনজাইমের ক্ষরণ হ্রাস পায়। কোষ্টকাঠিন্য, অর্শরোগ, অজীর্নতা প্রভৃতি রোগ দেখা
    দেয়;
  • হৃদপিন্ডের কার্যক্ষমতা কমে আসে, দৈহিক পরিশ্রমও কম হয়;
  • রেচণতন্ত্রের (Renal Tract) কার্যক্ষমতা কমে আসে;
  • রক্তস্বল্পতা, হজমের ব্যাঘাত হওয়ায় লৌহের পরিশোষণ কমে আসে;
  • স্নায়বিক জটিলতা হওয়ার ফলে Parkinson’s I Alzheimer’s রোগ দেখা দেয়। এছাড়াও স্মরণশক্তি লোপপেতে থাকে;
  • বয়স্ক মহিলাদের ক্ষেত্রে ৫০ বছরের পর মাসিক বা ঋতুস্রাব বন্ধ হয়ে যায়, একে মেনোপজ বলে। এই মেনোপজেরসময় ডিম্বাশয় নিষ্ক্রিয় হয়ে পরার সঙ্গে সঙ্গে বেশ কিছু শারীরিক ও মানসিক পরিবর্তন দেখা যায়। মূলত এ পরিবর্তনইস্ট্রজেন হরমোন কমে যাওয়ার ফলে আসে। মেনোপজ হলে শরীরের বিভিন্ন হাড়ের জয়েন্টে ব্যাথা, রুক্ষ মেজাজ,হট ফ্ল্যাশ, দেহের মধ্যভাগে হঠাৎ করে চর্বি জমা, ভ্যাজাইনাল ড্রাইনেস, চুলকানি, ঘুম একেবারে কমে যাওয়া ইত্যাদি সমস্যা দেখা যায়; এবং
  • পুরুষদের ক্ষেত্রেও ৩০ বছরের পর থেকে প্রতি বছর টেস্টোস্টেরন হরমোনের মাত্রাও ১ শতাংশ করে কমতে থাকে।মূলত ৭০ বছরের পর পুরুষদেরও মেনোপজ হয়, যাকে অ্যান্ড্রোপজ বলা হয়।

বয়স্ককালে মানসিক সমস্যা:

বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন শরীরিক সমস্যার সাথে সাথে বিভিন্ন মানসিক সমস্যাও দেখা যায়। গবেষণায় দেখা গেছে ৬০ বছর বয়সের ঊর্ধ্বে ১৫% মানুষ কোন না কোন মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। বার্ধক্যজনিত মানসিক সমস্যায় বিষন্নতা রোগ, উদ্বেগ জনিত রোগ, ডিমেনশিয়া বা স্মৃতিভ্রম রোগ, সিজোফ্রেনিয়া, বাইপোলার মুড ডিসঅর্ডার বা দ্বি-প্রান্তিক আবেগীয় রোগ, প্রলাপ করা, ঘুমের সমস্যা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
বয়স্ককালে এ জাতীয় শরীরিক ও মানসিক সমস্যা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পুষ্টি চাহিদাকে প্রভাবিত করে।

বয়স্কদের পুষ্টি চাহিদা:

  • ৪০ বছর বয়স থেকেই শরীরিক কর্মক্ষমতা হ্রাসসহ দেহে নানবিধ পরিবর্তন আসতে শুরু করে, তাই জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞগণ ৪০ থেকে ৫৯ বছর বয়স পর্যন্ত প্রতি ১০ বছরের জন্য প্রয়োজনীয় ক্যালরির শতকরা ৫ ভাগ কম গ্রহণ করার সুপারিশ করেছে। তারপর ৬০ থেকে ৬৯ বছর বয়সে ১০ ভাগ এবং ৭০ বছর বয়সের পর আরও ১০ ভাগ ক্যালরি কম গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়েছে। বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের খাদ্য শক্তির (ক্যালরি) চাহিদাও কমতে থাকে। যদিও এটা অনেকটাই নির্ভর করে তাদের কাজের ধরন ও শরীরের পুষ্টির অবস্থার উপর। একজন বয়স্ক নারীর প্রতিদিন প্রায় ১৩০০ কিলোক্যালরি এবং পুরুষের ১৮০০ কিলোক্যালরি গ্রহণ করতে হবে (স্বাস্থ্যগত অবস্থা বিবেচনা করে);
  •  বয়স বাড়ায় সাথে সাথে দেহ কোষের ক্ষয় বেশি হয় বলে ক্ষয়পূরণকারী খাদ্য (আমিষ) যেমন- মাছ, মাংস, দুধ, ডিম, ডাল
    ইত্যাদি বেশি করে দিতে হবে। এ সময় প্রায় প্রতি কেজি শরীরের ওজনের জন্য ০.৮-১.০ গ্রাম আমিষ গ্রহণ করতে হবে।
    খেয়াল বাখতে হবে মোট শক্তি চাহিদার ১১-১২ শতাংশ যেন আমিষ থেকে আসে। এই আমিষের অন্তত এক তৃতীয়াংশ প্রাণিজ আমিষ থেকে গ্রহণ করা ভালো। এছাড়াও বাদাম, শস্য ও ডাল জাতীয় খাদ্য, যাতে আমিষের পরিমাণ বেশি তা গ্রহণ করতে হবে। বয়স্ককালে পর্যাপ্ত আমিষ গ্রহণ না করলে শরীরে বিশেষ করে পায়ে পানি জমে। একে গাফোলা রোগ বা ঊফবসধ বলে;
  • বয়স্ককালে সহজেই বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি আক্রমণ করে। এজন্য এসময় রোগ প্রতিরোধকারী পুষ্টি উপাদান যেমন- খনিজ লবণ ও ভিটামিন সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ করতে হবে। সবুজ পাতা জাতীয় শাক, অন্যান্য সবজি ও তাজা ফলমূল-বিভিন্ন ধরণের ভিটামিন ও খনিজ উপাদানের ভান্ডার হিসেবে পরিচিত। তাই তাদের ভিটামিন ও খনিজ উপাদানের অভাব পূরণের জন্য পর্যাপ্ত শাক-সবজি ও ফলমূল দৈনিক খাদ্য তালিকায় থাকতে হবে;
  • অধিকাংশ সময়ে দেখা যায় এ বয়সে অনেকের কোষ্টকাঠিন্যে হয়ে থাকে। কোষ্টকাঠিন্য দূর করার জন্য আঁশ জাতীয় খাদ্য
    যেমন শাক-সবজি ও ফল-মূল খেতে হবে। শাক-সবজি খেতে কারও অসুবিধা হলে দিনে অন্তত ২ (দুই) বার ফল খেতে হবে। তবে ডায়াবেটিস রোগীদের ফল খাওয়ার ক্ষেত্রে গ্ল্যায়মেসিক ইনডেক্স ((Glycemic Index) এর মান বিবেচনায় নিতে হবে। তাছাড়া কোষ্টকাঠিন্য দুর করার জন্য ইসুবগুলের ভূষিও খাওয়া যেতে পারে;
  • প্রতিদিন পরিমিত পরিমাণ বিশুদ্ধ পানি পান করতে হবে;
  • বয়স্কদের সাধারণতঃ ক্যালসিয়ামের অভাবে হাঁড় নরম, পাতলা ও ভঙ্গুর হয়ে থাকে। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে
    ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাদ্য যেমন দুধ, দই ও দুগ্ধ জাতীয় খাদ্য, ছোট মাছ ও শাক-সকজি খেতে হবে;
  • বার্ধক্যে বিশেষ ধরনের রক্তস্বল্পতা দেখা যায়, একে পার্নিসিয়াস এ্যানেমিয়া ((Pernicious Anaemia) বলে। প্রধানত
    ভিটামিন বি১২ (কোবালামিন) এর অভাবে এ রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। ভিটামিন বি১২ সাধারণত প্রাণিজ খাদ্য উৎস থেকে পাওয়া যায়, যেমন- যকৃত, মাছ, মাংস, ডিম, দুধ প্রভৃতি। এছাড়া লৌহের অভাবেও রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। তাই এ সময় লৌহসমৃদ্ধ খাদ্য যেমন কলিজা, ডিম, আটা, শাক-সবজি ও ফলমূল খেতে হবে। ভিটামিন সি শরীরে লৌহের শোষণ বৃদ্ধি করে। কাজেই বয়স্কদের ভিটামিন সি যুক্ত খাদ্য (পেয়ারা, কুল, আমলকি, জাম্বুরা) খেতে হবে এতে লৌহের শোষণ বৃদ্ধির সাথে সাথে ভিটামিন সি- এর চাহিদাও পূরণ হবে;
  • পরিমিত পরিমাণ লবণ খেতে হবে এবং ভাতের সাথে আলাদাভাবে লবণ খাওয়া হতে বিরত থাকতে হবে। কারণ, অতিরিক্ত
    লবণ গ্রহণে শরীরে সোডিয়ামের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং শরীর থেকে অতিরিক্ত ক্যালসিয়ামের নিঃসরণ ঘটায়। যার ফলে
    হাঁড়ের ঘনত্ব কমে যায়। এছাড়াও রক্তনালীতে লবণের পরিমাণ বেড়ে গেলে রক্তের ঘনত্ব বৃদ্ধি পায় এবং অভিস্রবণ প্রক্রিয়ায় রক্তনালীতে পানির পরিমাণ বেড়ে যায় এবং সর্বোপরি যার ফলে রক্তচাপ বৃদ্ধি পায়;
  • বিভিন্ন ধরনের রোগ ও ক্যান্সার প্রতিরোধে পর্যাপ্ত পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ শাক-সবজি ও ফলমূল খাদ্য তালিকায়
    থাকতে হবে। যেমন: ভিটামিন-সি, ভিটামিন-ই এবং বিভিন্ন ধরনের ক্যারটিনয়েড (Lutein, Lycopene,
    Cryptoxanthin);
  • এসময় শরীরে ভিটামিন-এ এর চাহিদা কমে যায় এবং একই সাথে রিবোফ্লাভিন, ভিটামিন-বি৬, বি১২ এবং খনিজ উপাদান
    জিংক এর প্রয়োজনীয়তা বৃদ্ধি পায়;
  • ক্ষূধামন্দা ও মুখের অরুচি বয়স্কদের একটি সাধারণ সমস্যা। বি গ্রুপের ভিটামিন গুলো ক্ষুধা মন্দা দূর, মুখের রুচি বৃদ্ধি,
    খাদ্যদ্রব্য হজম, পরিপাক ও বিপাকে সহায়তা করে থাকে। কাজেই বৃদ্ধদের বি গ্রুপের ভিটামিন সমৃদ্ধ খাদ্যগুলো বেশি করে খেতে হবে;
  • বয়স্কদের হালকা ব্যায়াম স্বাস্থ্য সম্পর্কিত জটিলতা হ্রাস করে এবং শরীরকে সুস্থ্য, সবল ও কর্মক্ষম রাখে। ব্যায়ামের ফলে
    শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন- পেশী, হৃদপিন্ড, পাকস্থলী, ফুসফুস, মস্তিষ্ক, অস্থি, রক্ত চলাচল ইত্যাদিকে সচল, সবল ও মজবুত করে। নিয়মিত ব্যায়াম অকাল বৃদ্ধরোধ, বহুমুত্র, রক্তচাপ, শরীরের ওজন ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ, হৃদরোগ
    ষ্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। তাছাড়া ব্যায়ামের ফলে সুস্থবোধ, মানসিক প্রফুল্লতা, ভাল ঘুম, কাজ-কর্মে আনন্দ, মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বৃদ্ধি ও হজম শক্তি বৃদ্ধি করে।
আরো দেখুনঃ   শিশুর মেধা বিকাশে ১০০০ দিনের গুরুত্ব

বয়স্কদের খাদ্য তালিকা:

পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা বয়স্কের পুষ্টি চাহিদার উপর ভিত্তি করে নতুন একটি ফুড পিরামিড (Food Pyramid Diagram) প্রণয়ন করেছেন। যাতে কোন খাদ্য বিভাগ হতে কতটা খাবার গ্রহণ করবে তা ধারনা করা যায়। পিরামিডে যে সকল খাদ্য উপরের দিকে
আছে তা কম পরিমাণে গ্রহণ করতে হবে। এখানে প্রতিদিনের খাদ্য গ্রহণের অনুমোদিত পরিবেশন হচ্ছে নিম্নরূপ:

১। শস্য জাতীয় ৬ পরিবেশন;
২। শাক-সবজি ৩ পরিবেশন;
৩। ফল ২ পরিবেশন;
৪। মাছ, মাংস, বীচি, ডিম, বাদাম ২ পরিবেশন;
৫। দুধ, দই, পনির ৩ পরিবেশন;
৬। সর্বোপরি কম স্থান জুড়ে আছে তেল, চর্বি, মিষ্টিজাতীয় খাবার, যা পরিমিত পরিমাণে গ্রহণ করতে হবে।

 

Previous

থানকুনি পাতার উপকারিতা ও অপকারিতা

SMART Food ফসল সমূহের বৈশিষ্ট্য ও পুষ্টিগুণ

Next

Leave a Comment